Tuesday, November 19, 2019

হাংরি জেনারেশন - বাংলা সাহিত্যে প্রথম আভাঁ গার্দ আন্দোলন

 
হাংরি জেনারেশন : বাংলা সাহিত্যে প্রথম  আভাঁ গার্দ  আন্দোলন  
অভিজিৎ পাল      
          ১৯৩১ সালে লেখা পল ভালেরির এই বক্তব্য দিয়ে আরম্ভ করি, 
কেননা পশ্চিমবাংলার হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের আভাঁ গার্দ 
কাজগুলোর ক্ষেত্রে বক্তব্যটা খাটে : “আমাদের কারুশিল্পগুলো উন্নত 
হয়েছিল, তাদের প্রকার ও প্রয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সময়ে, তা 
বর্তমান সময় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, এবং বস্তুসমূহের ওপরে 
তখনকার লোকেদের প্রভাবক্ষমতা আমাদের সময়কার লোকেদের 
তুলনায় তুচ্ছ ছিল । আমাদের টেকনিকের বিস্ময়কর ক্রমবিকাশ, 
তারা যে অভিযোজ্যতা এবং যথাযথতা  অর্জন করেছে, তারা যে 
ধারণাগুলো আর অভ্যাসগুলো তৈরি করেছে তা নিশ্চিত করে যে
 সৌন্দয্যের প্রাচীন সংজ্ঞায় গভীর পরিবর্তন আসন্ন। সমস্ত 
কারুকলাতে একটি বস্তুগত উপাদান রয়েছে যা আর আগের মতো 
বিবেচনা বা অনুশীলন করা যায় না, যা আমাদের আধুনিক জ্ঞান 
এবং শক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয় । গত বিশ বছরে পাত্র বা স্থান বা 
কাল প্রাচীনকালে যা ছিল তা থেকে একেবারে আলাদা । কারুকৃতির 
পুরো কৌশলে রূপান্তর ঘটাতে আমাদের অবশ্যই অন্যরকম উদ্ভাবন 
আশা করতে হবে, যার ফলে  শৈল্পিক আবিষ্কার নিজেই প্রভাবিত হবে, 
এমনকি আমাদের কারুকৃতির ধারণায় বিপুল ও আশ্চর্যজনক 
পরিবর্তন আনবে। "
          পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোণের সময় থেকে আভাঁ গার্দ কাজগুলো নিজেদের মুক্ত মঞ্চ পেয়ে গিয়েছিল । লক্ষনীয় যে এই বিস্ফোরণ সম্ভব হয়েছিল হাংরি জেনারেশনের সাহসী কার্যক্রমের কারণে । তাঁরাই পথপ্রদর্শক । হাংরি জেনারেশন দেখিয়ে দিতে পেরেছিল যে কেবল একফালি কাগজ বা একফর্মার পত্রিকা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে উথালপাথাল ঘটিয়ে দিতে পারে ; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকার বা সংবাদপত্রের দয়াদাক্ষিণ্যের প্রয়োজন নেই । এটি তাঁদের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান যা ডাডা এবং সুররিয়ালিস্টদের তোলপাড়ের সঙ্গে তুলনীয় । মনে রাখা প্রয়োজন যে হাংরি জেনারেশনের এই ফালিকাগজ ও এক ফর্মার পত্রিকা তাঁদের রচনাবলীকে আমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় পৌঁছে দিয়েছিল । 
        এই প্রসঙ্গে অলোক গোস্বামী লিখেছেন: “এই সম্মীলিত পদক্ষেপের ফলেই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুল পদক্ষেপগুলোও পারেনি গতিরোধ করতে। আর তাই লিটল ম্যাগাজিনকে কে বা কাহারা সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেই তথ্য আজ আর প্রাধান্য পায় না। তার পরিবর্তে উঠে আসে সোমেন চন্দ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার,শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষ,বাসুদেব দাশগুপ্ত, মলয় রায়চৌধুরী,উদয়ন ঘোষ,অরূপরতন বসু,কৃষ্ণগোপাল মল্লিক,সুবিমল মিশ্র,সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,দেবেশ রায় এবং এরকম আরও অসংখ্য নাম। এদের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনাকে পাঠকের সামনে প্রথম তুলে ধরেছে লিটল ম্যাগাজিনই। গড়পড়তা সাহিত্যের পরিবর্তে পাঠককে আগ্রহী করেছে নতুন রচনারীতির স্বাদ গ্রহণ করতে। সেই প্রচেষ্টা যে বিফল হয়নি তার প্রমাণ,পরবর্তিতে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো বাধ্য হয়েছে নিজেদের ছাঁচ থেকে বেরিয়ে ওদের কারো কারো লেখা ছাপতে। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়নি। সেসব লেখকেরা জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না রেখে শুধু মাত্র লিটল ম্যাগাজিনকেই তাদের রচনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিন শুধু তাদের লেখাই প্রকাশ করেনি, সীমিত সামর্থ সত্বেও সেসব লেখকেদের বইপত্রও প্রকাশ করেছে। করে চলেছে। সুতরাং থোড় বড়ি খাড়া সাহিত্যের চর্চা করার পরিবর্তে ব্যতিক্রমী এবং নিরীক্ষা মূলক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলা সাহিত্যের সৃজনীধারাটাকে সজীব রেখেছে যে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই সেটা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লিটল ম্যাগাজিন যদি এই দায়িত্ব পালন না করতো তাহলে বাংলা সাহিত্যের দশা কী হোত তার প্রমাণও হাতের কাছে মজুত আছে। বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকাগুলো পাঠক মনোরঞ্জনের ফাঁদে আটকা পড়ে রীতিমত ধুঁকতে শুরু করেছে। একদা হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হওয়া দুর্গাপুজো সংখ্যাগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বকর্মা পুজো সংখ্যায়। তাতেও যেহেতু সামাল দেয়া যাচ্ছে না তাই এখন সাহিত্য সম্ভারগুলোর সঙ্গে বিনামূল্যে চামচ, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, শ্যাম্পুর স্যাসে বিতরণ করেও লোক টানতে হচ্ছে। এরপর আগামীতে যদি পুজো সংখ্যাগুলো জন্মাষ্টমী সংখ্যায় পরিণত হয় এবং বাই ওয়ান গেট ওয়ান ব্যবস্থা চালু হয় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যেহেতু প্রসাদ কবির সুরে স্বখাত সলিল সংক্রান্ত গানটা গাইতে পারছে না তাই নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে অজুহাত দিচ্ছে বাঙালি পাঠকের উদাসীনতাকে। সেই অজুহাত যে কতটা মিথ্যে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যার প্রতি পাঠকের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। আমার বক্তব্যকে কারো যদি অতিশয়োক্তি মনে হয় তাহলে তাকে অনুরোধ করব বইমেলায় কিংবা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় গিয়ে বিক্রির পরিসংখ্যানটা জেনে নিতে। এই জনপ্রিয়তাও শুধু নতুন রীতির গল্প কবিতা প্রকাশের কারণে বৃদ্ধি পায়নি, সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে যে ধরণের চর্চা লিটল ম্যাগাজিন করে চলেছে সেসব বাণিজ্যিক পত্রিকার কাছে কল্পনাতীত।”   এখন “আভাঁ গার্দ” বিষয়টির তাত্বিক দিকটি দেখা যাক । পিটার বার্জার তো বলেইছেন যে “আভাঁ গার্দ কী ? প্রশ্নটা শুনলেই মনে তা উস্কানিমূলক ।” তিনি সত্য কথা বলেছেন । পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের উল্লেখ করলে তা উস্কানিমূলক প্রস্তাব হয়ে দাঁড়ায় ।
          সাহিত্য, ছবি আঁকা, সঙ্গীত ইত্যাদির ক্ষেত্রে “আভাঁ গার্দ” শব্দটা এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে ; সৈন্যবাহিনীর একেবারে সামনের সারিতে যে দলটা শত্রুপক্ষের ক্ষমতা আঁচ করার জন্য এগিয়ে যায়, ইংরেজিতে  ভ্যাঙ্গার্ড বা ফ্রণ্টলাইন, বাংলায় বলা যেতে পারে ‘অগ্রদূত’ বা ‘অগ্রগামী-দল’, তাদের । ফরাসি সৈন্যবাহিনীতে ১৭৯৪ সালে সামনের ঝটিকাবাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল আভাঁ গার্দ যাদের বার্তার ওপর নির্ভর করে সেনাবিহিনী এগোতো ; বলা বাহুল্য যে পরের দলটাকে বলা হতো ‘রিয়ার গার্ড’ । ১৮২৫ সালে অভিধাটি প্রথম প্রয়োগ করেন সাঁ সিমনিয়াঁ  ওলিন্দে রডরিগেস তাঁর “শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি” ( “L’artiste, le savant et l’industriel” ) প্রবন্ধে। রডরিগস লিখেছিলেন যে শিল্পীদের উচিত “জনগণের অগ্রণী হিসাবে কাজ করা" কেননা , সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য "শিল্পকলার শক্তি প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততম”; তিনি বলেছিলেন যে তাঁরা ভিশনারি এবং সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন । উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে বামপন্হী বিপ্লবীরা রাজনৈতিক সংশোধনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের চিহ্ণিত করার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছিল অভিধাটি । বামপন্হী ভাবধারা থেকে বিযুক্ত হয়ে ইউরোপে অভিধাটা প্রয়োগ করা আরম্ভ হয় নিরীক্ষামূলক, অরক্ষণশীল, প্রথাবিরোধী, ক্যাননমুক্ত, বৈপ্লবিক, অনৈতিহ্যগত নান্দনিক বা কান্তিবিদ্যা-সম্বন্ধিয় উদ্ভাবন বা নবপ্রবর্তনকে বোঝাতে, যা প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং যা সৃজনকারী ও ভোক্তার মাঝে সমালোচনা হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল । সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আভাঁ গার্দ মূলত স্হিতাবস্হাকে আক্রমণ করে এবং     প্রথাসিদ্ধ প্রচলনের পাঁচিল ভেঙে ফেলে পরিধিকে অবিরাম বাড়াতে থাকে ; হাংরি জেনারেশন তাইই করেছিল এবং সেকারণে সদস্যরা জেলহাজতে গিয়েছিল । ডাডাবাদী বা আধুনিকতাবাদী সাহিত্য  থেকে অবিরাম ঘটে চলেছে এই প্রক্রিয়া এবং সেই কারণেই সৃজন-সেনাদের আচমকা বাঁকবদলকে বলা হয়েছে আন্দোলন । 
         বর্তমান কালখণ্ডে আভাঁ গার্দ বলতে বোঝায় কোনও বুদ্ধিজীবি, লেখক এবং শিল্পী গোষ্ঠীর কাজকে,  যাঁরা সেই কাজগুলোকে তাঁদের বিশেষ বার্তার মাধ্যমে প্রচলিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে উপস্হাপন করেন । অবিরাম হবার দরুন এককালের বৈপ্লবিক ধারাকে সমাজের মূলদলটি বা ‘রিয়ার গার্ড’ নিজের দলে মিশিয়ে নেয়, যার ফলে আবার নতুন আভাঁ গার্দ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। গ্যাব্রিয়েল ডিজায়ারে লাভেরদান্ত তাঁর “ফ্রম দি মিশন অফ আর্ট অ্যাণ্ড রোল অফ অর্টিস্টস” বইতে লিখেছেন, “শিল্প, যা সমাজের অভিব্যক্তি, নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে তার সর্বোচ্চ উড়ালে, সবচেয়ে উন্নত সামাজিক প্রবণতায় : তা হল প্রকাশকর্তার পূর্বগামী । সুতরাং জানবার জন্য যে শিল্প প্রবর্তকের উদ্দেশ্য পূরণ করছে কিনা,  সত্যিই আভাঁ গার্দ দলের মানুষ কিনা, একজনকে জানতে হবে যে মানবিকতা কোন দিকে যাচ্ছে, মানবজাতির নিয়তি কী, খুলে স্পষ্ট দেখিয়ে দিতে হবে যাবতীয় কলুষ, কল্মশ, হিংস্রতা, নোংরামি ইত্যাদি যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের বুনিয়াদ । 
          ফ্রান্সেই আভাঁ গার্দের বা ভ্যাঙ্গার্ডের সূত্রপাতের কারণ ছিল, যেমন পশ্চিমবাংলায় হাংরি জেনারেশনের উদ্ভব । প্রথমত সেই সময়ের ফ্রান্সে প্রতীকি স্তরে ফরাসি সংস্কৃতিতে লাঠি ঘোরাতেন সমাজের গণ্যমান্য অভিজাতরা এবং তাঁদের নান্দনিক মূল্যবোধকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া সাধারণ মানুষের কাছে জরুরি ছিল । অর্থাৎ সমান্তরাল সমাজটিতে এগিয়েছিল অভিজাত মূল্যবোধ আর পেছিয়েছিল সংস্কৃতি সৃষ্টিকারীদের মূল্যবোধ । আভাঁ গার্দের আগমন জরুরি হয়ে উঠেছিল সেই মূল্যায়ণ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজেদের মূল্যায়ণ পদ্ধতি স্হাপন করা । ইংরেজিভাষী অঞ্চলে তা ছিল উল্লম্ব, অর্থাৎ কেউ ওপরে এবং বাদবাকি ক্রমশ তলার দিকে ধাপেধাপে । উপনিবেশগুলোতেও ইংরেজরা এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে গিয়ে চারিয়ে দিতে পেরেছিল : গ্রেটেস্ট, গ্রেট, মেজর, মাইনর ইত্যাদি । বোদলেয়ারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, র‌্যাঁবো-ভেরলেনের চরিত্র নিয়ে গুজব ছড়ালেও, কেউই তাঁদের, তাঁরা যখন লিখছিলেন, মাইনর হিসাবে তকমা দেগে দ্যায়নি । ফ্রান্সে লাতিন কোয়ার্টারের মতন তখনকার অ-ভদ্রলোক অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকাশক অধ্যুষিত এলাকায় মাতামাতি হলেই তারা ছিল এগিয়ে । ওপরে নয় ।
          ফরাসি সাহিত্যে ষোড়শ শতক থেকেই মিলিটারি মেটাফর প্রয়োগ করা হয়েছে । একদল লেখককে বলা হতো “La Brigade” অর্থাৎ ‘বৃহৎ সৈন্যদল’ ; ব্রিগেড বলা হতো, তাতে সেনাবাহিনীর বহু ব্যাটালিয়ান ও কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত । শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাজের ভ্যাঙ্গার্ড হতে হবে, এই আওয়াজ প্রথমে ফ্রান্সে তুলেছিলেন ক্লদ অঁরি দ্য সাঁ-সিমঁ, ১৮২৫ সালে প্রকাশিত তাঁর  Opinions Litteraires, philosophiques et industrielles bhite : "আমরা, শিল্পীরা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ভ্যানগার্ড হয়ে উঠব। শিল্পের শক্তি আসলে সবচেয়ে কার্যকর এবং দ্রুততম। আমাদের কাছে সব ধরণের অস্ত্র রয়েছে: যখন আমরা নতুন ধারণা প্রস্তাব করতে চাই, তখন আমরা সেগুলো শ্বেতপাথরে খোদাই করি বা আমরা সেগুলো একটি ক্যানভাসে আঁকি । " বৌদ্ধিক বিপ্লবের একেবারে সামনে দিকে শিল্পসাহিত্য থাকে, এই  ধারণা উনিশ শতকের মধ্যভাগে আবার দেখা দিয়েছিল, আবারও একটা বিপ্লবের ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল আর সমস্ত ফরাসী বিপ্লব প্যারিসেই শুরু হয়। ফ্রান্সে উনিশ শতকের শেষে এই অভিধাটির মান পরিবর্তিত হয়েছিল । তারপর থেকে নির্দিষ্ট শিল্প-সাহিত্যিক গোষ্ঠীকে চিহ্ণিত করার জন্য প্রয়োগ করা আরম্ভ হয়েছিল এবং নতুন গোষ্ঠীটিকে নান্দনিক অন্বেষণের অগ্রভাগ হিসাবে গণ্য করা হতে লাগলো কেননা নতুন গোষ্ঠী আগের  শৈল্পিক মানদণ্ডকে ভেঙে ফেলতে সফল হল । বিপ্লবী আলোকপ্রাপ্তির সম্মিলিত প্রত্যয়টি বিলিন হয়ে গিয়ে "আভাঁ গার্দ" অভিধাটি সাধারণত শিল্পী-সাহিত্যিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হওয়া আরম্ভ হয় । অনেক গোষ্ঠী থাকলেও, যে গোষ্ঠী একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করে, আর তখনকার থিম্যাটিক মোটিফগুলির সাথে জড়িত নয় এবং নতুন অন্বেষণ চালাচ্ছে, আর অন্বেষণের প্রক্রিয়াতে পরীক্ষামূলক, তারা “আভাঁ গার্দ” হিসাবে চিহ্ণিত হতে লাগলো।
        পরিবর্তনের মূল অভিগমন হল যে এটি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের বিপ্লবের পরিণতি, ঘটনার বৈপরীত্য,  যা সমস্ত কিছু উল্টে পাল্টে দিতে চায়, যা হাংরি জেনারেশন করতে পেরেছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি বিশেষ ধারণার প্রতিপাদন করে এবং তাহল এই যে মানবজাতির অগ্রগতি বা শিল্পসাহিত্যের বাঁকবদল একটি "বিদার" ( Rupture ) এর পরিণতি, যা হঠাৎ করে অভিনবতাকে আবিষ্কার করে এবং যা আগে থেকে চলছে এমন  সমস্ত কিছুকে পাল্টে দ্যায় এবং প্রাক্তন চিন্তাধারার পদ্ধতিতে রূপান্তরণ ঘটায়। ততোদিনে যা প্রাক্তন তা পুঁজিবাদের চাপে বাজারের খোরাক হয়ে ওঠে । ১৯৫০ সালে ইসিদোরে ইজু, যিনি ত্রিস্তঁ জারার মতন রোমানিয় ছিলেন, প্যারিসে আরম্ভ করেন ‘লেট্রিজম’ আন্দোলন, যাকে পরাবাস্তবের পরের আভাঁ গার্দ আন্দোলনের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ; ‘লেট্রিস্ট’ আন্দোলনকারীরা অক্ষর, বাক্য ও ছবির মিশ্রণ ঘটিয়ে কাজ করতেন । ইজু বলেছিলেন যে বিশ্ব সাহিত্য ক্রমশ “Le ciselant” বা স্তব্ধতা থেকে ক্রমশ “l’amplique” দিকে এগিয়ে যায়, অর্থাৎ একটা সময় আসে যখন সমসাময়িক সমাজ নতুন মাত্রাটিকে গ্রহণ করে নেয় এবং তা হয়ে ওঠে doxa বা গৃহীত কল্পমূর্তি, যার পুনরাবৃত্তি ততোদিন চলতে থাকে যতোদিন না আবার নতুন ‘ভ্যাঙ্গার্ড’ এসে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে । ইজু এই নবীনতাকে বলেছিলেন Novatique, যাকে ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের Tel quel বা “যেমন আছে” পত্রিকাগোষ্ঠীর ভাবুকরা, বিশেষ করে রলাঁ বার্থ ও মিশেল ফুকো,  বলা আরম্ভ করলেন Rupture বা “বিদার” । 
          Tel quel গোষ্ঠীর সদস্যরা আধুনিক চিন্তাধারার সূত্রপাতকে ইতিহাসে ১৮৮৬ নাগাদ একটি “জ্ঞানতাত্বিক ভাঙন” বা “epistemological break” হিসাবে চিহ্ণিত করলেন কেননা সেই বছর মালার্মে তাঁর টেক্সটগুলো প্রকাশ করেছিলেন যা Album de Vers et de Prose নামে গ্রন্হাকারে ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু এই বছরেই ফরাসি কবি মোরেয়ার “আধুনিক” সাহিত্যিক ইশতাহার Manifesto of Symbolism প্রকাশিত হয় Le Figaro সংবাদপত্রে যা প্রকৃতপক্ষে ছিল ১৮৫৬ সালে Le Salon de-তে বোদলেয়ারের লেখা “আধুনিকতা” সম্পর্কিত বক্তব্য । বোদলেয়ারের বক্তব্যটি পৃথিবী জুড়ে আধুনিকতার সংজ্ঞার স্বীকৃতি পায় । বোদলেয়ার বলেছিলেন যে “বিশুদ্ধ শিল্প”  [Ktema es aei অর্থাৎ অনন্তকালের সম্পদ] নামে পাশ্চাত্য চিন্তায় প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে তার জায়গায় আনতে হবে আধুনিক শিল্পবোধ কে, যা “আপেক্ষিক” ; শিল্প হল আংশিক শাশ্বত ও আংশিক সমসাময়িক বললেন বোদলেয়ার, এবং সমসাময়িকতা থাকার দরুণ তা আধুনিক । তিনি শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব সমকালীনতার এই ব্যাখ্যার জয়কে কোনো দুর্বোধ্য শাশ্বতের বিপক্ষে তুলে ধরলেন । 
      মোরেয়া তাঁর ইশতাহারে বলেছিলেন, "সমস্ত চারুকলার মতো, সাহিত্যেরও অবিরাম বিকাশ হয়: একটি আবর্তের সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তন কঠোরভাবে নির্ধারিত  [...]। শৈল্পিক বিবর্তনের প্রতিটি নতুন পর্ব তার আগের বৌদ্ধিক গোষ্ঠীর অবসানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হয়, তার ঠিক আগের গোষ্ঠী অনিবার্যভাবে ফুরিয়ে যায় ।” তিনি বলেছেন  সাহিত্য এবং শিল্প ক্রমাগত নৃশংস এবং বিরোধী ভাবনাচিন্তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। এটাই মৌলিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস যা আভাঁ গার্দের সৃষ্টিবাদী ধারণাটিকে, নানা আন্দোলন সত্ত্বেও, টিকে থাকতে দিয়েছে। উপরোক্ত তিনটি মৌলিক ফরাসি সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে যে কেন আভাঁ গার্দ ধারণাটি ফরাসি সমালোচনামূলক শব্দভাণ্ডারে আবিষ্কার হয়েছিল এবং এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফরাসি সমালোচনামূলক ইতিহাসে সিম্বলিজম, ডাডা, ফিউচারিজম, পরাবাস্তববাদ এবং লেট্রিজমের মতো  ভ্যানগার্ডগুলির বর্ণনা করার সময়ে আভাঁ গার্দ অভিধাটি প্রয়োগ করে হয় । বস্তুত ১৮৮৬ থেকে ১৯৬০র দশক পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বাঁকবদলগুলোকে চিহ্ণিত করার জন্যই আভাঁ গার্দ অভিধাটি প্রয়োগ করা হয় ।                                                 
          ইতালিয় ভাবুক রেনাতো পোজিওলি ১৯৬২ সালে তাঁর  ‘আভাঁগার্দের তত্ব’ রচনায় ( Teoria dell’arte d’avanguardia ) অভিধাটির অন্তর্গত সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চের ধ্রুবকগুলো ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক এবং দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপের প্রয়াস করেছিলেন । তিনি চিত্রকলা, কবিতা, সঙ্গীত ইত্যাদির  ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তগুলো ছাপিয়ে বলতে চেয়েছেন যে অগ্রদূত বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ আদর্শ বা মানদণ্ডের শরিক হবার দরুণ তা প্রতিফলিত হয় তাঁদের প্রচলবিরোধী বা সমাজরীতিঅনীহ জীবনশৈলীতে । জার্মান সমালোচক পিটার বার্গার ১৯৭৪ সালে তাঁর ‘থিয়রি অফ দি আভাঁ গার্দ’ বইতে বলেছেন যে সমাজের রাজনৈতিক সমালোচনা করে আবির্ভূত হলেও, পুঁজিবাদের সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির কাজে যে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থাকে তাদের অসাড় করে দেয় বা যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে চলে যায় । আভাঁ গার্দের ধারণা মূলত শিল্পী, লেখক, সুরকার এবং চিন্তাবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এবং তাঁদের কাজগুলো মূলধারার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং  সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রান্তসীমায় তাঁদের অবস্হান থাকলেও পাশ্চাত্যদেশগুলোর বেলায় যে বক্তব্য খাটে তা বঙ্গসমাজের মতন গরিবদেশগুলোর বেলায় খাটে বলে মনে হয় না ।
        পশ্চিমবঙ্গে আভাঁ গার্দ কবে থেকে আরম্ভ হল তা চিহ্ণিত করা সহজ । আভাঁ গার্দ অভিধাটি যুদ্ধসংক্রান্ত হবার দরুন এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে কবিলেখকদের যুদ্ধের সময়কাল দিয়ে তা দেগে দেয়া যায়, অর্থাৎ ষাটের দশকে যখন সাহিত্যশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ড আক্রান্ত হল হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারী সাহিত্যগোষ্ঠির দ্বারা ।  পশ্চিমবঙ্গে যেমন, প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করার পাশাপাশি শিল্পায়নের দ্বারা উৎপাদিত কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত গণ সংস্কৃতিকেও বাঙালি আভাঁ গার্দ প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলির প্রতিটি হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ পণ্য — এগুলি এখন মোটামুটি কারুশিল্পের প্ল্যাটফর্মের কাজ করে — অথচ এগুলো সত্যিকারের কারুশিল্পের আদর্শ নয়, উৎপাদন সম্পর্কিত  লাভ-ক্ষতির উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত। বাজার তাই নকল বা যান্ত্রিক এবং প্রায়শই আভাঁ গার্দ সংস্কৃতি থেকে চুরি করে আনুষ্ঠানিক নকশা বা আবিষ্কার ব্যবহার করে তারা আভাঁ গার্দ কারুশিল্পের চেয়ে উন্নত হওয়ার ভান করে। যেমন বিজ্ঞাপন যাঁরা তৈরি করেন সেই দোকানদাররা পরাবাস্তবতা থেকে চাক্ষুষ পদ্ধতি চুরি করে চলেছে, যদিও বিজ্ঞাপনের কাজগুলো সত্যই পরাবাস্তব প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে পারে না । বিজ্ঞাপন যেটা তৈরি করে তা হল ( kitsch ) ‘কিৎশ’-- আভাঁ গার্দের বিপরীত এবং তা রিয়ার গার্ডও নয় ।
          রেনাতো পোজিওলি যে তর্কবিন্দুগুলো দিয়ে আভাঁ গার্দকে চিহ্ণিত করেছিলেন সেগুলো পশ্চিমবাংলায় ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন এবং পরবর্তী বাঁকবদলকারী পত্রিকাগোষ্ঠির  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । ১ ) আভাঁ গার্দ বলতে বোঝায় পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথে যাত্রা ; ২ ) মার্কসবাদীরা আভাঁ গার্দ বিরোধী ; ৩ ) মার্কসবাদীরা আভাঁ গার্দকে ‘বুর্জোয়া শিল্প, নামে অভিহিত করতে ভালোবাসেন, কেননা তাঁরা আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দেন ; ৪ ) আমেরিকা -ইংল্যাণ্ডে আভাঁ গার্দ শব্দটা ব্যবহার করা হয় না, কেননা তা ফ্রান্সে উদ্ভুত, তাঁরা পোস্টমডার্ন বলা পছন্দ করেন । ; ৫ ) রাজনৈতিক এবং নান্দনিক আভাঁ গার্দ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বামপন্হীদের কারণে ; ৬ ) উৎসাহের ঝরণা থেকে আভাঁ গার্দ শিল্প-সাহিত্যের জন্ম ; ৭ ) আভাঁ গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিকরা কাজের তুলনায় প্রকাশভঙ্গীতে বেশী আগ্রহী ; ৮ ) পুরাতনপন্হীরা নিজেরাই নতুনের আবির্ভাব চান কিন্তু দেরিতে স্বীকার করেন ; ৯ ) আঁভা গার্দ জনপ্রিয় নয় তার কারণ জনগণের কাছে পৌঁছোতে দেয়া হয় না ; ১০ ) রোমান্টিসিজম আভাঁ গার্দের চেয়ে জনপ্রিয় ছিল কারণ তখন অভিজাত সমাজ অবলুপ্ত হয়ে নতুন কর্মীশ্রেনি ও মধ্যবিত্তের উদ্ভব হচ্ছিল ; ১১ ) বহু আভাঁ গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা পছন্দ করেন না ; ১১ ) একটি আভাঁ গার্দ আন্দোলন দেখে পরের প্রজন্ম দ্রুত নিজেদের আভাঁ গার্দ আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চায় ; ১২ ) আভাঁ গার্দ আন্দোলনের লেজ দীর্ঘ হয় কেননা অংশগ্রহণকারীরা পরস্পরের অচেনা এবং পরস্পরের পৃষ্ঠভূমি ভিন্ন হওয়া সত্বেও দল গড়ে তোলেন ; ১৩ ) সব দেশের আভাঁ গার্দকে বিশ্বায়ন নিজের অন্তর্গত করে ফেলতে চায় ;  ১৪ ) পুঁজিবাদের চাপে অনেকে আভাঁ গার্দ ত্যাগ করে বৈষয়িক সাফল্য চান, যেমন আগেকার কবি-শিল্পীরা রাজ দরবারের সাহায্য পেতেন ।
          পিটার বার্জার ১৯৮৪ সালে লেখা তাঁর  ‘থিয়োরি অফ দি আভাঁ গার্দ’ বইতে রেনাতো পোজিওলির চেয়ে বেশ ভিন্ন তর্কবিন্দু দিয়েছিলেন, যেমন ১) জনারগুলোর পার্থক্য  [ genres ] ছলনাময়, যদিও কবিতা, চিত্রকলা ইত্যাদি নাম দিয়ে তাদের আলোচনা হয় ; ২) শ্রোতা-পাঠক-দর্শকরা কখনও কৌতুহলশূন্য নয় বরং একদেশদর্শী ; ৩ ) ব্যাখ্যাকারী নিজের পক্ষপাত আরোপ করে ; ৪ ) এটা অবশম্ভাবী যে ব্যাখ্যাকারী নিজের কালখণ্ডের প্রেক্ষিতে অতীতকে যাচাই করবে ; ৫ ) ধর্ম অনেকসময়ে বাগড়া দ্যায় কেননা ধর্ম দুর্দশা কাটাবার প্রয়াস করলেও আনন্দ লাঘব করে ; ৬ ) মানুষ যখন বুঝতে পারল যে ধর্ম ব্যাপারটা ছলনাময় তখন সে এর নাম দিল দর্শন [ বিশ্বাস নয় ] ; ৭ ) আদোর্নো যদিও বলেছেন যে আভাঁ গার্দের কোনো অভীষ্ট নেই, পিটার বার্জার বলেছেন যে আভাঁ গার্দের অভিষ্ট হল আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো ; ৮ ) আভাঁ গার্দ যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, পুঁজিবাদের কারণে তাকেই প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে ; ৯ ) আভাঁ গার্দ শিল্প-সাহিত্য ব্যক্তির প্রয়োজনকে অন্তত কাল্পনিক তৃপ্তি দ্যায় যেগুলো প্রতিদিনকার জীবনযাপনে অবদমিত থাকে ; ১০ ) একটি আন্দোলনের সঙ্গে আরেকটি আন্দোলনকে মিশিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়, তা করলে তাদের উদ্দেশ্যকে গুলিয়ে ফেলা হবে ; ১১ ) ডাডা আন্দোলনের কোনো শৈলী ছিল না, তার ছিল উদ্দীপনা ও তত্ত্ব, এবং আঁভা গার্দ অভিধার তারাই জন্মদাতা, তারা প্রতিটি সংস্হার বাইরে নিজেদের রাখতে চেয়েছিল ; ১২ ) ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন যে যান্ত্রিক যুগে শিল্প-সাহিত্যকে গ্রাহ্য করায় প্রভূত পার্থক্য ঘটে গেছে, কেননা তা এখন যতো ইচ্ছে উৎপাদন হয় ; ১৩ ) শিল্প-সাহিত্য এখন মুনাফার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কবিতা খাপ খায় না ; ১৪ ) রাজনৈতিক না হলে আভাঁ গার্দ হয় না ; ১৫ ) শিল্প-সাহিত্য প্রতিদিনের জীবন থেকে আলাদা, তা ম্যাজিকাল, তার প্রতিটি কারুকাজকে একসঙ্গে গ্রথিত করা হয়, জঘন্য ধারণার মতো কবিদের একসঙ্গে থাকা উচিত ; ১৬ ) শিল্পসাহিত্য তার কার্যকরী মূল্য খুইয়ে ফ্যালে তখন তা শিক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ; ১৭ ) নাগরিক তার প্রতিদিনের জীবনে ‘কর্মচারী’ হিসাবে ক্ষুদ্র হয়ে গেছে ; শিল্প-সাহিত্যে তাকে ‘মানুষ’ হিসাবে খুঁজে পাওয়া যায় ; ১৮ ) সংস্হাগুলো তাদের অন্তর্ভুক্ত কাজকেই কেবল শিল্প-সাহিত্য বলে মনে করে -- এটা নান্দনিক কারণে ঘটে না, সামাজিক কারণে ঘটে ; ১৯ ) সত্যকার আঁভা গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিক সিস্টেমকে ভেঙে ফেলতে চান, অবশ্য আজকের দিনে আধুনিক শিল্পী দুশঁর পক্ষে তা কঠিন হতো কেননা তিনি সিস্টেমকে ভাঙলেন অথচ তার অন্তর্গত হয়ে গেলেন [ হাংরি জেনারেশনের শৈলেশ্বর ঘোষ শেষ বয়সে সিস্টেমকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ] ; ২০ ) সংস্কৃতি এখন ইনডাস্ট্রি যার দরুন শিল্প-সাহিত্যকে খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাজার ; ২১ ) রেডিমেড জিনিসকে শিল্প-সাহিত্যে বদলে ফেললে তা শিল্প-সাহিত্য থেকে মুক্ত হয়ে যায় ভাবা ভুল, কেননা রেডিমেড ব্যাপারে শিল্পের অভিব্যক্তি খুঁজে পায় ব্যক্তি ।
          আভাঁ গার্দ সম্পর্কিত আলোচনা পুনরুজ্জীবিত হল থিয়োদোর আদোরনোর সমর্থনের দরুণ । সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্যের একটা বড়ো অংশ তখনও এবং এখনও যেহেতু বুর্জোয়াজিকে কুন্ঠিত ও হতবুদ্ধি করে, আদোরনো যুক্তি দিয়ে প্রথাগত নান্দনিক মূল্যবোধ ও আঙ্গিকের পক্ষে বৌদ্ধিক বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছিলেন । কিন্তু যাঁরা শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহ্যে কেবল নতুনত্বের জন্যই নতুনত্ব আনতে চান, এবং যাঁদের কাজের প্রধান উদ্দেশ্য হল শক দেয়া আর স্ক্যাণ্ডালাস হওয়া, তাঁদের উচিত নয় আদোরনোকে আশ্রয় করে নিজেদের সমর্থন আদায় করা । যেমন, স্ত্রাভিনস্কির ‘রাইট অব স্প্রিঙ’ এর প্রথম অনুষ্ঠানকে আদোরনো আভাঁ গার্দের স্বীকৃতি দেননি, কেননা তা ছিল ‘লোকতাত্বিক’ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মতৃপ্ত । স্ত্রাভিনস্কির সেই অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবিরোধিতা ছিল না এবং তা আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি ।   
          বিশ শতকের যে কাজগুলোকে আদোরনো আভাঁ গার্দের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাতে ছিল আমাদের নিজেদের মধ্যেকার এবং জগতসংসারে অবস্হিত যা কিছু  প্রিমিটিভ বা আদিম । এই আদিমতার কারণেই আফ্রিকার ভাস্কর্যের প্রতি পিকাসোর আকর্ষণ কিংবা মনদ্রিয়ানের ছবি আঁকায় কেবল রেখার প্রয়োগ । সেই সময়ে পাশ্চাত্য জগত জড়িয়ে পড়েছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের হত্যালীলায়, ঔপনিবেশিক  একীকরণ আর দ্রুত পণ্যায়নে, ফলে ডুবে যাচ্ছিল সেই একই বুনো সভ্যতায় যা কাটিয়ে ওঠা নিয়ে তারা এককালে গর্ব করত । আদোরনোর মতে, সমাজের আত্মসংরক্ষণ সমাজ-অনুমোদিত আত্মত্যাগ থেকে    পার্থক্যহীন হয়ে গিয়েছিল : যা আদিম মানবের মধ্যে, অহং-এর আদিম দিকগুলোয় পাওয়া যায় । আদোরনোর আভাঁ গার্দ তত্ত্ব বাস্তবের এই আদিম বৈশিষ্ট্য থেকে উৎসারিত হয় ; প্রিমিটিভ বৈশিষ্ট্যকে যা দাবিয়ে রাখে তার বিরোধিতা করে আভাঁ গার্দ ।  এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতি, দর্শন, সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে আদোরনো জীবনভর বলেগেছেন যে “আত্মসংরক্ষণের লড়াইয়ের চেয়েও জীবনের কাজ অনেক বেশি।” আদোরনো তাঁর ‘নেগেটিভ ডায়ালেকটিকস’ ( ১৯৬৬ ) বইতে লিখেছেন যে এই তর্কে আত্মসংরক্ষণ “ইতিহাসের এতাবৎ মান্যতার বাইরে সর্বনাশের নিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়।”    
          আভাঁ গার্দকে সমর্থনে আদোরনো ‘আগে থেকে পাওয়া’ ব্যাপারকে গুরুত্ব দেননি । আভাঁ গার্দকে ‘নতুন’ হতে হবে । উনি বলেছেন যে সিরিয়াস সঙ্গীতকে, সিরিয়াস শিল্পের মতনই, একই সঙ্গে নতুন আর  স্বীকৃত উভয়ই হতে হবে ।    প্রকৃত আভাঁ গার্দের গুণগ্রাহীতা আসে ঐতিহ্যকে বুঝতে পারার মাধ্যমে কেননা তা একই সঙ্গে তার থেকে দূরে সরে যায় আবার তার  ধারাবাহিকতাও । ফালতু অথচ অভিনব কিছু সৃষ্টি করা যেমন সহজ তেমনই সহজ অসার ও গতানুগতিক কিছু সৃষ্টি করা । অভিনবতার খাতিরেই অভিনবতা সৃষ্টি করা আর জনগণের বাজারকে খাওয়ার জন্য সৃষ্টি করায় সে ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য থাকে না । নতুন কাজ যতোই শকিঙ হোক, সেই শক কিসের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে তার বোধ না থাকে তাহলে তা হবে বেশ্যাসুলভ । আদোরনোর বক্তব্য থেকে আমরা যা পাই তা হল যে নতুনের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং অমনভাবে তৈরি থাকা তখনই সম্ভব যখন একজন গ্রাহী তার শিক্ষিত প্রবৃত্তির দ্বারা স্বীকার করতে পারবে যে প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকাজটি ঠিক কী । আদোরনোর মতে প্রকৃত সৃষ্টির মানসপ্রতিমার অভিজ্ঞতার অভাব, যার জায়গা নিয়েছে চিত্তবিনোদন বাজারের লালিকা আর রেডিমেড বাঁধাধরা জিনিসপত্র, সেগুলোই প্রাথমিক স্তরে জার্মানদের মধ্যে গড়ে দিয়েছিল সিনিসিজম যা শেষ পর্যন্ত বিটোফেনের মানুষদের বদলে ফেললো হিটলারের মানুষে ।
       বোদলেয়ারের “আধুনিকতাবাদ”-এর প্রেক্ষিতে তাঁর বৌদ্ধিক উত্তরসূরীর কথা বলার জন্য আজকে "অতিরিক্ত-আধুনিকতাবাদ"-এর বক্তব্য রাখতে গেলে একজনকে নিজেকে "উত্তরসমসাময়িক-পরবর্তী" কাঠামোর মধ্যে উপস্হাপিত করতে হবে। জাঁ পল সার্ত্রে যেমন তাঁর জার্নাল Les Temps Modernes-এ বলেছেন,  কবিতাকে সমসাময়িকতার সহজ অত্যাচার ("চরম" বা তার “অভাব”) থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে হবে এবং ভবিষ্যতের বিষয়ে প্রত্যাশা দেওয়ার কথা ভাবতে হবে; কবিতাকে অবিরাম  ভবিষ্যত আবিষ্কার করতে হবে। কবিকে কেবল তাঁর নিজস্ব সমসাময়িকের চেয়ে বেশি হতে হবে, এবং সংক্ষিপ্ত শর্তাবলী, বলা যেতে পারে যে কবিকে ভবিষ্যতের উদ্ভাবন করতে হবে। তাঁর কবিতাকে ভাবতে হবে যে কবিতা কী হতে পারে, তাত্ত্বিকভাবে এবং উপায়ের দিক থেকে তো বটেই,  ভাবের নতুন রূপের দিক থেকেও। সম্ভবত এতে কোনও সমসাময়িকতা নেই, তবে কমপক্ষে এটি কল্পনাশক্তিকে আরও সক্রিয় করবে, আরও বেশি ভালভাবে বেঁচে থাকার নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করার ক্ষমতা এবং আগত বিশ্বের তাৎপর্যের ভিত্তিগুলির কল্পনা করবে। আমরা যদি কবিতার "আধুনিক সমসাময়িক" যুগে প্রবেশ করতে চাই, তবে আমাদের বোদলেয়ারের "আপেক্ষিকবাদী" দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও কিছু যুক্ত করতে হবে । র‌্যাঁবো তাঁর সবচেয়ে অসাধারণ মুহুর্তগুলিতে  "Le voyant" ["ভাবাবেশ"] বলেছিলেন। কবি কেবল তাঁর নিজস্ব "সময়"-এ সীমাবদ্ধ হতে পারেন না । তাঁর দূরদর্শিতার ক্ষমতা থাকতে হবে। কবিতায় স্থায়ী, বাস্তব এবং ভবিষ্যত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
          প্রশ্ন উঠতে পারে যে "আভাঁ গার্দ" সাহিত্য-অভিধার জন্ম কেন বোদলেয়ারের  "আধুনিকতা" সম্পর্কিত বক্তব্যের পৃষ্ঠভূমিতে "সমসাময়িক"কে যুক্ত করেছে । আভাঁ গার্দ-এর  সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল জনগণের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করা এবং তার উন্নতি করা। এটি কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, ইউরোপে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পথও ছিল,  যা সংস্কৃতিবিশেষকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি এবং কিছু সামাজিক উথালপাথালের মাঝেও আভাঁ গার্দ ধারণাটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিল যা জনগণকে এগিয়ে যেতে প্ররোচনা দিয়েছিল। ফ্রান্সে বিপ্লবের পরে আভাঁ গার্দ একটি সফল পরিবর্তন এনেছিল ।  সেই সময় যে লোকেরা রাস্তায় নেমে লড়াই করছিল তারা শিল্প এবং কবিতা সম্পর্কে খুব বেশি জানত না (ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ, ২০০৫ ) আভাঁ গার্দ কবি বা শিল্পীর কাছে প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল তাদের মতামত এবং চিন্তাভাবনা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার দক্ষতা। ধারণাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি শিল্পের সমস্ত দ্বন্দ্ব এবং সমস্যাগুলি সমাধান করতে এগিয়ে গিয়েছিল কারণ কারুকৃতিগুলো শিল্পীকে তার  দক্ষতা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়। আভাঁ গার্দ ছিল “আধুনিক” ব্যাপার ।  
        ফ্রান্সে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, বিপ্লব ঘটার পরে ১৮৪০ সালে সর্বহারা শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায়  গণতান্ত্রিক চেতনা লগ্নী ও শ্রমের প্রতি বিদ্বেষের ফলে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রের প্রতি মোহিত হয়ে ওঠে। শিল্প সমালোচক ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ তাঁর  "আভাঁ গার্দ ও কিৎশ" প্রবন্ধে যেমন উল্লেখ করেছিলেন: একই সমাজে একই সাথে টি.এস. এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ কবিতার মতো কাজ হয় আবার টিন প্যান অ্যালির গান হয় কিংবা ব্রাকের একটি চিত্রকর্ম এবং একটি স্যাটারডে ইভনিঙ পোস্টের কভার হয়; চারটিই একই সংস্কৃতির অংশ এবং একই সমাজের পণ্য। কলকাতায় যেমন দেখি ‘কোয়ার্টজ পাবলিশারের আভাঁ গার্দ বইয়ের পাশাপাশি স্টার জলসা আর জি টিভির কিৎশিয় সিরিয়ালগুলো । যেমন সাহিত্যের ক্ষেত্রে হাংরি, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, নিমসাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে তেমনই ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে চিত্রকলার ক্ষেত্রে একট আভাঁ গার্দ চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, এরকম বললে অত্যুক্তি হয় না।এবং পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের হাতে তা ক্রমশই আরাে বিকশিত হয়েছে, আরাে সংহতি অর্জন করেছে। এই বিকাশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চিত্রচর্চার সঙ্গে সমান্তরাল হলেও, তা থেকে স্বতন্ত্র। অথাৎ পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের কাজে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা, শিল্পী ভেদে প্রত্যেকের নিজস্বতা সত্ত্বেও, এক সামগ্রিক ঐক্যের ইঙ্গিতবাহী; আর সেই ঐক্যের যে বিশেষ ধরণ, সেটা অন্যান্য অঞ্চলের শিল্পীদের প্রকাশভঙ্গি থেকে একটু আলাদা।  গণেশ পাইন, রবিন মণ্ডল, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকারের আঁকা ছবিগুলোর পাশাপাশি বাংলা আর হিন্দি সিনেমার পোস্টার । অবনী ধর, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল মিশ্র, সুভাষ ঘোষ-এর ন্যারেটিভের পাশাপাশি পণ্যসাহিত্যের ন্যারেটিভ । প্রথম দিকে আভাঁ গার্দ একটি বিমূর্ত বা অযৌক্তিক শিল্পের মতো বিকাশ করা হয়েছিল যা মানুষের চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি প্রকাশ করবে। আভাঁ গার্দ ধারণাটি শক্তিশালী হবার কারণ এটি মানুষকে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে বা এমনকি “সৃষ্টিকর্তাকে” ছাপিয়ে যাবার সদিচ্ছা প্রদান করে ।
         সাহিত্য-শিল্পকে পণ্যায়নের প্রেক্ষিতে স্লাহভয় ঝিঝেক সম্প্রতি এই সম্ভাবনার বিষয়ে চিন্তা করে বেলেছেন যে বর্তমান পুঁজিবাদকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা সম্ভবত দূরদর্শীতার অভাব; তাঁর মতে আমাদের একথা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় যে পশ্চিমা পুঁজিবাদও আমাদের গণতন্ত্র এবং সুখের ধারণা এনে দিয়েছে এবং সম্ভবত এগুলি  অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলোর সাথে সংযুক্ত ; সুতরাং আমরা যদি গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দিই তবে যা জরুরি তা সাম্যবাদ বা একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যবস্থা দ্বারা পুঁজিবাদের প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানানো নয় কেননা ওদুটো প্রমাণিত হয়নি যে তারা উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। এখনও পর্যন্ত প্রমাণ হয়নি যে আধুনিকতাবাদী কবিরা বোদলেয়ারের প্রস্তাবিত মডেলের তুলনায় "আরও ভাল" হতে পারে এমন সৃষ্টিধারা প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বোদলেয়ারের পাঠবস্তুগুলো প্রতিষ্ঠানের ভাষার সমসাময়িক, এবং সমস্ত আধুনিক গণতন্ত্রের বিশ্বজুড়ে সেটাই ঘটে গেছে । আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে যে হিটলরিয়ান ফ্যাসিবাদ "অবক্ষয়ের শিল্প" নামের কাজকে সেন্সরযোগ্য মনে  করেছিল এবং কমিউনিস্ট সরকারগুলো "পাতি বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের" ধারণাটি আবিষ্কার করেছিল। আর ধর্মের ধ্বজাধারীদের কথা বাদ দিন কেননা আমরা জানি ধর্মীয় উৎসাহ সাহিত্য-শিল্পকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় আগেও মেতেছিল আর এখনও তাই করে চলেছে, কারণ তাদের ধর্মভিত্তিক নৈতিক শৃঙ্খলার সাথে মানায় না বলে মনে করেন ধ্বজাধারীরা। পশ্চিমবঙ্গে অনিল বিশ্বাস এককালে এইরকম ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন । হিন্দুত্ববাদীরা বহু শিল্পীর কাজের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে, হুসেনকে তো দেশছাড়া করেছিল ।
      আরেকটি জিজ্ঞাসা হল  যে "আভাঁ গার্দ" সাহিত্যে-অভিধার জন্ম কেন বোদলেয়ারের এই উপলব্ধি থেকে উৎসারিত হয়েছিল যে "আধুনিকতা"র নতুন নান্দনিক বক্তব্যের সাথে "সমসাময়িক"-এর  সম্পর্ক ছিল। নতুন নান্দনিক বোধকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য "আধুনিক" শব্দটি আকস্মিকভাবে বোদলেয়ারের কাছে হাজির হয়নি । ফ্রান্সের সাহিত্যে এর দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে । ১৬৮৮ সালে ফরাসি লেখক শার্ল পেরা ( Charles Perrault ) তাঁর চার খন্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ড “প্রাচীনতা ও আধুনিকতার সমান্তর” প্রকাশ করেছিলেন ( Parallele des anciens et des modernes )। এই বইটি ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে "La querrelle des Anciens et des Moderns" বা “প্রাচীন ও আধুনিকতার বিতর্ক” নামে পরিচিত।  শার্ল পেরা "আধুনিক" দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক ছিলেন এবং বলেছিলেন সমসাময়িক সাহিত্য ক্লাসিকাল সাহিত্যের মতোই ভালো হতে পারে । বিতর্কটি শুরু হয়েছিল যখন শার্ল পেরা তাঁর “লুই দ্য গ্রেটের শতক” ( "Le siecle de Louis le Grand") কবিতাটি তৎকালীন ফরাসি রাজা লুই চতুর্দশকে একজন প্রবুদ্ধ শাসক হিসাবে প্রশংসা করে লিখেছিলেন এবং তাতে বলেছিলেন যে রাজা চারুকলার উন্নতির জন্য এত কিছু করেছেন যে সমসাময়িক কাজগুলো ধ্রুপদী কারুকৃতির তুলনায় উন্নত হয়ে গিয়েছে । প্রতিবাদে বোলেউ-ডেসপ্রা ( Boileau-Despreaux )ও রাসিনে তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন এবং  "প্রাচীন যুগের" সমর্থকদের নেতা হিসেবে, ক্লাসিকাল কারুকৃতির তুলনায় সমসাময়িক শিল্পের আধিপত্যকে অস্বীকার করেছিলেন, আর জাগতিক বিষয়-আশয়ের প্রতি লোভের নিন্দা করেছিলেন, যা  ঘটেছিল শার্ল পেরার ক্ষেত্রে , যিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার স্পষ্ট বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দুই দলের মধ্যে ঐতিহাসিক কলহের অবশেষে সমাধান হয়েছিল যখন দুই দলের প্রতিনিধি ফরাসি অ্যাকাদেমির সামনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মিটমাট করে নেন । তা সত্ত্বেও, অষ্টাদশ এবং উনিশ শতক পর্যন্ত ফ্রান্সে তার প্রভাব থেকে গিয়েছিল
        বোদলেয়ার সেই সময়ে অনুধাবন করেছিলেন যে আধুনিকতা সম্পর্কিত তাঁর ১৮৫৬ সালের পাঠবস্তুটিতে "আধুনিক কবিতা" ও আধুনিকতাবাদের ধারণাকে পুনরুদ্ধার করার অর্থ কী। অনেকে মনে করেন যে বোদলেয়ারের সমকালীনতার এই বক্তব্যটি আর্তুর র‌্যাঁবোর কাব্যদর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে,  যেমনটি তাঁর কবিতা “নরকে এক ঋতু”র উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন: Il faut etre absolument moderne - “আপনাকে একেবারে আধুনিক হতে হবে।” প্রকৃতপক্ষে যদি কেউ র‌্যাঁবোর উদ্ধৃতিটি গভীরভাবে পাঠ করে, তবে তা ( anti-phrase ) "বিরোধী বাক্যাংশ" হিসাবে দেখা যেতে পারে: র‌্যাঁবো তাঁর সমসাময়িকতাকে অপছন্দ করতেন, এটা তাঁর কাছে পাতিবুর্জোয়া, মামুলি, মানুষদের বস্তুবাদী সমাজের প্রতি কাপুরুষোচিত আত্মসমর্পণ বলে মনে হয়েছিল।
          যদি প্রকাশ্যে পুরস্কৃত কবিতা ( যেমনটি র‌্যাঁবো তাঁর নিজের সমসাময়িক কবিদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছিলেন : সালি প্রুধোম, ফ্রাঁসোয়া কোপি,, বাঁভিল, প্রমুখ  কবিরা "সমাজের কাছে "ঋণী" হন, তাহলে তাঁরা তো ফালতু বুর্জোয়া মহাবিশ্বের অংশ ছিলেন, যাকে র‌্যাঁবো তুচ্ছ-তাচ্ছ্যল্য করেছেন , তারপরে র‌্যাঁবো "কবিতা" নিয়ে আরকিছু করতে চাননি। "নিজেই নিজের সমসাময়িক" হওয়ার জন্য তিনি  তাঁর সময়ের অংশ হতে পারেন, তাঁর নিজস্ব বিশ্বে থাকবেন, এর প্রসঙ্গগুলো এবং সমস্যাবলীতে মগ্ন হয়ে উঠবেন। যদি, সমস্ত কাব্যিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, বস্তুবাদী কদর্যতার সমসাময়িকতাকে উপেক্ষা করা না যায় , তবে তিনি কবিতাকে ত্যাগ করে  চলে যাবেন ভাগ্যান্বেষণে, তারপরে বাণিজ্যিক ব্যবসায়ী এবং শেষ অবধি রাজা মেনেলিককে তাঁর স্বাধীনতায় সহায়তা করার জন্য বন্দুক চোরাচালানের কাজ করবেন যাতে রাজা ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন । এটিই ছিল র‌্যাঁবোর প্রতি সমসাময়িকতার আহ্বান। র‌্যাঁবোর কাছে “আপনাকে একেবারে আধুনিক হতে হবে” ছিল  নেতিবাচক, তাঁর কাব্যিক "দৃষ্টিপ্রতিভা," অর্থাৎ ভিশন পরিত্যাগ, তাঁর স্বপ্ন এবং কাব্যিক সৃষ্টির জীবনকে ত্যাগ করার বার্তা। 
    "সমসাময়িকতা" ( contemporaneity ) এবং "আধুনিকতা" ( modernity )-র মধ্যেকার  অভ্যন্তরীণ যোগসূত্র একটি নির্দিষ্ট সময়কালে শিল্প বলতে কী বোঝায় তা নির্ধারণের জন্য বিশেষ সময়ে ঐতিহাসিকভাবে একটি মূল গুণক প্রবর্তন করেছিল। ইতিহাসকরণ ( historization ) একটি পর্যায়কালীনতার ( periodization ) জন্য পথ ছেড়ে দিয়েছিল এবং অবশ্যই "আভাঁ গার্দ" ধারণাটি যুগচেতনার অংশরূপে সাহিত্য-শিল্পের ফলাফল হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এর অতিমাত্রার বৈকল্পিকতার কথা যা সার্ত্রে বলেছেন তা ওপরে আলোচনা করেছি ;  লেখকেরা তাঁর সময়ের রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, আদর্শগত বিতর্কে অংশ নেন এবং গড়ে তোলেন "বাস্তববাদী", "হস্তক্ষেপবাদী" শিল্প-সাহিত্য যেমন আজকের সমসাময়িক কাব্য রচনায় ল্যাঙ্গোয়েজ পোয়েট্রি আন্দোলনের লুই জুকোস্কি, বব পেরেলম্যান ও চার্লস বার্নস্টেইন এবং ফ্রান্সের জাঁ মারি গ্লাইজ-এর বিশৃঙ্খলার রচনাগুলো বর্তমান কালখণ্ডের আভাঁ গার্দ। সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আজ যে কবিতাকে সর্বাধিক উদ্ভাবনী বলে বিবেচনা করা হয় তা হল "আপনার সমসাময়িকতা প্রকাশ করুন" ।  "চরম সমসাময়িক" লেখার একটি প্রশংসনীয় অংশ হ'ল দৈনন্দিন জীবনের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এবং উপস্থাপন। এই সময়ের ফরাসি কবি ও তাত্বিক অঁরি মেশোনিক স্লোগান দিয়েছেন - “কবিতায় আপনাকে নিজের সমসাময়িক হতে হবে"।
          ইউরোপীয় ঐতিহ্য এবং মার্কিন সংস্কৃতির বর্তমানবাদের স্বাভাবিক দার্শনিকতায় "রাজনৈতিক" দায়বদ্ধতা সমসাময়িকতার কবিতা হিসাবে সমালোচকদের  স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে "আধুনিকতাবাদ"কে ছাড়িয়ে বা অতিক্রম করে, একটি অনৈতিহাসিক "উত্তর-আধুনিকতাবাদ" ( post-modernism ) ওই প্রবণতার সাথে খাপ খায় এবং এটি প্রত্নতত্ত্ব,  সময়ের ধারাবাহিকতা এবং ঐতিহাসিক সংশ্লেষ ইত্যাদিকে বাতিল করার মাধ্যমে নাটকীয় উপায়ে কার্যকর করে: প্রতিটি উপাদান (কবিতার মাত্রা ও ছন্দ , থিম, চিত্র, শব্দ, গদ্যযুক্তি ইত্যাদি) যে উত্তর-আধুনিক কবিতা বা গদ্যে উপস্হাপন করা হয় তা তাৎক্ষণিকভাবে "সমসাময়িক" হিসাবে স্বীকৃতি পায় । রক্ষণশীল আলোচকরা সেহেতু উত্তর-আধুনিকতা কে মান্যতা দিতে চান না, যেমন তাঁরা আভাঁ গার্দকেও স্বীকৃতি দিতে চান না । হাংরি জেনারেশন আজ বাংলা সাহিত্যপাঠের বিষয় । ছাত্রদের সেকারণে ‘আভাঁ গার্দ’ ধারণাটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি ।

Monday, November 18, 2019

হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীদের ভাষার প্রভাব

হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীদের ভাষার প্রভাব
Image result for হাংরি আন্দোলন
        ক্ষুধার্তের কোনো ভাষা হয় না, যা হয় তা গোঙানি আর কাতরানি : ঠাকুমার কাছে শুনেছি ক্ষুধার্ত পরিবার দরোজায় এসে কীভাবে কাৎরে বলতো, ‘একটু ফ্যান হবে গো মা।’ বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, “ভাত দে হারামজাদা নয়তো মানচিত্র খাবো” কিংবা’"ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, নিয়মকানুন। দৈবাৎ ধরো তোমাকে যদি পেয়ে যাই, সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে"। এটা ক্ষুধার্তের ভাষা নয়, এটা একজন ক্রুদ্ধ মধ্যবিত্ত কবির আস্ফালন ।

          হাংরি আন্দোলনের গদ্যলেখক ও কবি সুবিমল বসাকের গবেষক তন্ময় ভট্টাচার্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন,“আমার মতে, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা হল একটা ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল। ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এবং আফটার এফেক্টে আখেরে উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। যদি ১৯৬২-১৯৬৫ এই সময়কালটাকে মধ্যিখানে রাখি, তাহলে এর আগেকার প্রচলিত ও বিখ্যাত সাহিত্যের সুর ও পরের প্রচলিত ও বিখ্যাত সাহিত্যের সুরে – হ্যাঁ, মেইনস্ট্রিমেরই, তফাৎ খুঁজে পাই আমি। ওই যে বললাম ‘আফটার এফেক্ট, তা ক্রমশ ছড়িয়ে গেছে সত্তর-আশি-নব্বইয়ের লেখায়। হয়তো স্পষ্ট নয়, রচয়িতারাও হয়তো জানেন না বা খেয়াল করেননি, কিন্তু অবচেতনে হলেও হাংরি আন্দোলনের ভালোটুকু তাদের লেখায় চলে এসেছে। পরিবেশনায়, শব্দব্যবহারে। তাই, আমার বিশ্বাস, হাংরি আন্দোলনকারীদের সবচেয়ে বড় অবদান পরবর্তী জেনারেশনের সাহিত্যিকদের একধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে যেতে দেওয়া। ১৯৬২-১৯৬৫ – এই সময়কাল ও হাংরিদের কর্মকাণ্ড বাংলায় না ঘটলে, আমার ধারণা, আরও বিলম্বিত হত এই অগ্রগতি। ষাট বছর পরে দাঁড়িয়ে, একজন তরুণ পাঠক হিসেবে পিছনের দিকে তাকালে, সমস্ত খুঁটিনাটি সরিয়ে মূল প্রভাবটুকুর দিকে খেয়াল রেখে আমার এটাই বারবার মনে হচ্ছে – হাংরিরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কিন্তু সাহিত্যের উপকারই হয়েছে তাতে। ‘The Last Days of British Raj’ বইতে লিওনার্ড মোসলে একটা কথা বলেছিলেন – ‘সুভাষ বোসের আত্মা লালকেল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলছিল তখন। ঠিক তেমনই, আমার মনে হয়, এই ষাট বছরের সাহিত্যের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে হাংরিদের আত্মা। দেখা যায় না, টের পাওয়া যায়।

          হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্হ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।”

          নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনাকালে প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলে, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের এই আন্দোলনের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তা’লে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবেনা বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে। সুভাষ ঘোষের গদ্যে থাকে সমস্ত ধড়িবাজ, রাজনীতিবাজ, সঞ্চয়িতাবাজ, পলিসিবাজ, নামকাতুরে মানুষের কথা; যারা আপাতনিশ্চিন্ততার মোড়কে মুড়ে রাখে নিজেদের দৈনন্দিন আর গান্ধীর বাঁদরের মতই কিচ্ছু না-দেখে না-শুনে না-বলে কাটিয়ে দিতে চায় রাত-দিন। আর, প্রাতিষ্ঠানিকতা এদেরই ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে ‘শিল্প’ বলে দাবি করে অন্য সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে দেয়। বেঁচে থাকাটা একটা দায় একটা নিয়ম হয়ে ওঠে পণ্যসমাজে। আর, সেই পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়... শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য- : আপনার গোলাম আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির... একটি সিগারেট। ...একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] । বুঝে নেওয়া দরকার হাংরি-প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনের নিভন্ত আগুন এবং সেই আগুনে শাসক-রাষ্ট্রের ক্রমাগত শান্তির জল ঢেলে যাওয়া; অথচ সেই নিভু আগুনের থেকে ফিনিক্সের জেগে ওঠা। নিওফ্যাসিজম্‌ বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভাবে দখল চালানো তো বটেই, তার সাথেই থাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আগ্রাসন। আর, পুঁজিবাদ নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তার উৎপাদন-পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, তেমনি সাহিত্যকেও যেহেতু পুঁজিবাদ পণ্য হিসেবেই দেখে, তাই তার উৎপাদন-কৌশলেও নতুন ফর্মুলা নিয়ে আসতে চায়। আর, সেই ফর্ম্যুলার অন্যতম হল, একদা যা ছিল প্রান্তিক, যা ছিল শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সের’ বাইরে, তাকেই কেন্দ্রের দিকে ঢুকিয়ে দেওয়া, শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সে’ তাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া। হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের সময় যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি তাদের ‘প্রান্তিক’ করে রেখেছিল, পরে সময়-সুযোগ বুঝে তাকেই প্রতিষ্ঠানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে নেয়। অ্যাণ্টি-কাল্‌চার ও কি বাজার-কাল্‌চার এ ঢুকে পড়ে? যখন তার প্রভাব এড়ানো যায়না আর, যখন ছাই হয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে ওঠে ফের তার ভাষা-সংস্কৃতি তখন বাজার নতুন ভাবে নামে? প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় বিগত সব প্রত্যাঘাতগুলো? একদা ‘ওরা অশ্লীল’ বলে চেঁচানো সাহিত্যিকেরাও লিখে ফেলেন হাংরি-দের কথা। বাণিজ্যিক ছবি হয়, সেখানে হাংরি-লেখক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রুফ-চেক্‌ করাতে মুখিয়ে থাকে। এ-ও তো এক সংস্কৃতি। প্রতিস্পর্ধাকে নমনীয় করে, দোষারোপ গুলোকে বড়ো করে প্রতিস্পর্ধী-‘সংস্কৃতি’-কে ভুলিয়ে দেওয়া। কারণগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া, প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতকে গুলিয়ে দেওয়া। পণ্যমুখর পুঁজিবাদে লেখক ও লেখাদের পণ্য করে তোলা, বিপণন কৌশলে চমক! আসলে, ভোগবাদ, পুঁজির সংস্কৃতি তার নীতি বদলায় না, কৌশল বদলে ফেলে। হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় লেখকের নয়। হাংরি লেখকেরা তাঁদের লেখালেখিতে জোর দিচ্ছেন পাঠের ওপর। অর্থাৎ, লেখকের ভাষাগত চাতুর্য, শব্দলালিত্য আর বিচার্য নয় বরং বিচার্য পাঠবস্তুটি। ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে হাংরি-দের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রানিং কমেণ্টারির মতোন অর্থাৎ, চলন্ত ধারাভাষ্যের মতো সাহিত্য। যা ঘটছে, যা অভিজ্ঞতা সেটাকেই গল্প বা কবিতায় তুলে আনা। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোসহ বহু প্রাচীনপন্থীর মতামত এই ছিল যে, কবিতা বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অথচ, হাংরি-দের কবিতা পড়লে কিন্তু তার উল্টোটাই মনে হয়। বড়ো বেশিই যেন বাস্তবের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে পাঠককে, সঙ্গে নিজেরাও। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে হইহই করে লেখক নিজেকেও এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লেখার মধ্যেই। এর ফলে কবিতার চিরাচরিত সম্বোধক-সম্বোধিত বা অ্যাড্রেসার-অ্যাড্রেসড নিয়ম ধাক্কা খাচ্ছে। সাহিত্য আর ততটা দূর থেকে বসে, নিরাপদে লেখার বিষয় থাকছে না; যখন পৃথিবী পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে তখন লেখাও পুড়তে বাধ্য। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। হাংরি-দের লেখায় আত্ম-কে আবিষ্কার, জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে...”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর ঔপনিষদীয় উপলব্ধি । রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা অন্য কোথাও, তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো। ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখাকে বিশ্লেষণ না করেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে তাকেই আত্তীকরণ করে বাজারজাত পণ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা। ‘নিম্নবর্গের’ এই সাহিত্যগুলোই প্রয়োজন হয়, যদি ভারতীয় সাহিত্যের ওলট-পালট, এগিয়ে চলাকে খুঁজতে হয়। বিশেষতঃ পণ্যসঙ্গমরত সমাজে যেখানে জীবন-মানুষ-শিল্প সবটাই ক্রমপণ্য হয়ে যাচ্ছে, তখন বিরোধিতার স্বর, রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্বরগুলোর হয়তো বেশিই প্রয়োজন; দ্রোহকে আরো ক্ষুরধার, শাণিত এবং সত্যসন্ধানী করে তুলতে।”

          সুবিমল বসাকের গ্রন্হাবলী আলোচনাকালে অধ্যাপক অলোক রায় বলেছেন, “সুবিমল বসাকের প্রথম উপন্যাস বা গদ্যন্যাস ‘ছাতামাথা’ (১৯৬৫) আমি পড়িনি । দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রত্নবীজ’ (১৯৯৬) কয়েক বছর আগে ছাপা হলেও সদ্য আমি পড়বার সুযোগ পেয়েছি। উপন্যাস, কিন্তু আদৌ অবসর-বিনোদনের সামগ্রী নয় । পড়ে চমকে উঠতে হয় । কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। একটা প্রবল আলোড়ন তোলা সম্ভব। অথচ সেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এটাই বিস্ময়কর। অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রত্যেক বছর বাংলায় যে একশো-দেড়শো উপন্যাস বেরোচ্ছে, তার নিশ্চয় বিশেষ একজাতের ভোক্তা আছে। তাঁরা ‘প্রত্নবীজ’ পড়তে উৎসাহ বোধ নাও করতে পারেন। বিশেষত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতাকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। ‘ঢোঁড়াইচরিতমানস’-এ সতীনাথকে টীকা-টিপ্পনীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলি’ উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষাব্যবহার চমকপ্রদ লেগেছিল একসময়। কিন্তু সশেষ পর্যন্ত চরিত্রকে ফোটাবার প্রয়োজনেই বিশেষ ভাষা ব্যবহার । তা না হলে অপরিচিত মহল্লা, ততোধিক অপরিচিত মানুষজন, আর তাদের ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগ -- অপরিচয়জনিত বিস্ময়রস সৃষ্টিতে সক্ষম।’  প্রত্নবীজ নানা কারণে অসামান্যতা দাবি করে। আমি আমার নিজের মত করে প্রত্নবীজ পড়েছি। আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আর একজন পাঠকের অমিল হতেই পারে। তবে সুবিমল বসাকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণশক্তি ও ভাষা ব্যবহারে নৈপুণ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।” 

          অজিত রায় লিখেছেন, “চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল।  শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।'  বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার।  আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন।  এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন।  সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল। ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা।  ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের।”

          উদ্ধৃতিগুলো দিলুম এইজন্যে যে পাঠকরা কীভাবে হাংরিদের লেখালিখিকে বিশ্লেষণ করেছেন তার একটা ধারণা মোটামুটি গড়ে ওঠে । সব কয়টি বক্তব্যেই একের সঙ্গে আরেকের কিছুটা বিরোধিতা আছে । আমি মনে করি যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম ভাষা নিয়ে চিন্তা করার কথা বলেছিলেন, তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন ভাষাকে নিজস্ব জগতে নিয়ে আসতে, যিনি যেমন পরিবেশ থেকে এসেছিলেন তিনি সেইভাবেই গড়ে তুলেছেন তাঁর ভাষার শরীর । হাংরি আন্দোলনকারীরা সবাই একই ধরণের ভাষা ব্যবহার করেননি, তার কারণ সবাই একই পৃষ্ঠভূমি থেকে আসেনি । 

         একটু আগে সুবিমল বসাকের কথা বলেছি, যিনি ঢাকার তাঁতিবাড়ি থেকে এসেছিলেন, তাঁর বাবা পাটনায় অতিনিম্নবিত্ত পাড়ায় স্যাকরার কাজ করতেন এবং দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন । সুবিমল ‘ছাতামাথা’ উপন্যাসের ন্যারেটিভে প্রয়োগ করেছিলেন ঢাকাই কুট্টিদের বুলি ; অন্যান্য গদ্যে তিনি শৈশবে যে অঞ্চলে বসবাস করতেন সেখানকার ‘ডায়াসপোরিক’ মিশ্র ভাষা প্রয়োগ করেছেন । অবনী ধরের বাবা সংসার ত্যাগ করে এক সঙ্গিনীর সঙ্গে বাউলজীবন কাটিয়েছেন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি ; অবনী ধর স্কুল পালিয়ে জাহাজের খালাসির চাকরিতে যোগ দেন, ফিরে এসে বস্তিতে থাকতেন, অতি-নিম্নবিত্তের জীবন, অসংগঠিত শ্রমিকরা যেধরণের কাজ করতে পারেন সবই করেছিলেন, মায় রাস্তায় হকারি ; সাহিত্য সম্পর্কে কোনো ধারণা বা শিক্ষা তাঁর ছিল না, এবং যেমন যেমন স্মৃতি তাঁকে চালিত করেছে তেমনই লিখে গেছেন গল্পগুলো, তাঁর জীবনের বিভিন্ন টুকরোয় গড়া, ফলে তাঁর ভাষা একজন অসাহিত্যিকের, নির্মম, অশোভন, আক্রমণাত্মক, পথ-চলতি গদ্যবিন্যাসে তৈরি । দেবী রায় ( প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া ) থাকতেন হাওড়ার একটি বস্তিতে এবং কৈশোরে রাস্তার চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছে বাবা-মা-ভাইয়ের সংসার চালাবার জন্য । হাওড়ার বস্তি থেকে উঠে-আসা মানুষের ভাষা নিয়েই তিনি সাহিত্যজগতে ঢুকেছিলেন । স্বাভাবিক যে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে পিএইচডির গবেষণাপত্রে পিনাকী দাশ, তাঁর মধ্যবিত্ত বিদ্যায়তনিক বোধ থেকে লিখেছেন, “ হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা ব্যবহার অনেক সময়েই আমাদের বোঝার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, কখনো বা তথাকথিত মার্জিত রুচিকে ধাক্কা দেয় আর এও ঠিক, অনেক সময়ে তাঁদের বিভিন্ন মতামত থেকে এমন অলঙ্ঘনীয় এক সত্য উঠে আসে যা আজকের বর্তমান সমাজ পরিস্হিতিতে আরো প্রাসঙ্গিক।”

            হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা হলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিকল্প ভাষাবিন্যাস গঠনের প্রয়াস। হাংরি আন্দোলনকারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নেননি, তবু তাঁদের  কণ্ঠস্বর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত- আগ্রাসী ( পরে নব্বুই দশকে অবশ্য সুভাষ ঘোষ সিপিএমে যোগ দেন ও চন্দননগর কমিটির সদস্য হন ; তৃণমূল ক্ষমতায় এলে শৈলেশ্বর ঘোষ তৃণমূলে যোগ দেন ) । রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে সেই দলের বিরোধিতা করা অসম্ভব হয়ে যায় । হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারগুলো খুঁটিয়ে পড়লেই টের পাওয়া যাবে । এটা ঠিক যে হাংরিরাও বামপন্হী দলের কবিদের  মতো পরিসর ও সময়কে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকেননি তাঁরা ; দ্রোহ, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক নান্দনিক এবং সামাজিক, ছিল তাঁদের আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। সুতরাং তাঁদের ভাষাও আশ্রয় করেছে শাসক-বিরোধিতার, বিদ্যায়তনিক শাসকদের মূল্যবোধ বিরোধিতার, প্রচলিত সাহিত্যিক মানদণ্ডের বিরোধিতার, ধিক্কারের । এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রতিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সেই কাঙ্খিত রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধ:স্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের  তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।
       
          বহু পাঠক হাংরি আন্দোলনকারীদের বইগুলো না পড়েই অশ্লীলতার দোষ খুঁজে পান, তা এইজন্য যে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও কবিতায় অশ্লীলতার মামলা হয়েছিল আর নিম্ন আদালতে দণ্ডাদেশ হয়েছিল। হাংরি আন্দোলনকারীদের বইগুলো না পড়েই, ইনটারনেটে যেটুকু পান তাতে চোখ বুলিয়ে নির্ণয় করে ফ্যালেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের আলোচকরা, কেননা সেখানে হাংরি আন্দোলনকারীদের বই যায় না । যেমন এলোরা জামান লিখেছেন,”কবিতা, গদ্য, সাহিত্য কর্মে এই সকল অশ্লীল ভাষার ব্যাবহার হাংরি জেনারেশনের কবিদের মাঝে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।” কিন্তু কার বা কাদের কোন লেখায় তিনি তা খুঁজে পেলেন সেকথা জানাননি । বাংলাদেশি আলোচক তামারা ইয়াসমিন ইনটারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অবশ্য লিখেছেন যে, “‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসঙ্গতিকে, এত অল্প সময়ে এভাবে কলমের আঘাতে আর কোনো সাহিত্যকেন্দ্রিক আন্দোলন, জর্জরিত করতে পারেনি।” শাহাদত জামান লিখেছেন যে, “প্রচলিত ছন্দ,অলংকার, বানানরীতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন এঁরা। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে ব্রাত্য শব্দাবলীর অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছেন হাংরিয়েলিস্টগণ।” পি এস কাজল লিখেছেন, “অনেকে মনে করেন হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু বর্তমান আধুনিক কবিদের  ( সরকারি দালাল গুলোকে বাদ দিলে যারা থাকে ) লেখা কবিতা বা তাদের চিন্তা চেতনা দেখলে আমার মনে হয় না এ আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । তবে এটা ঠিক আন্দোলনের রকমেরও পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যায়নি তবে পরিবর্তন হয়েছে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনশীলতার মত ।”

           আমার সম্পর্কে অজিত রায় লিখেছেন, এবং যা পড়ে পাঠক আন্দাজ করতে পারবেন আমার গদ্য আসর কবিতা কেন ভিন্নপথযাত্রী,” কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন।  যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন। তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়। জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে। হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে।  তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়। সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা। সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।”  

          আমি আমার বিভিন্ন উপন্যাসে পটভূমি অনুযায়ী গদ্যবিন্যাস গড়ার চেষ্টা করেছি, প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ থেকে এই সিরিজের পাঁচটি উপন্যাসে, সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ উপস্হাপনের জন্য ভাষাকে ব্যবহার করেছি । ‘নামগন্ধ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকায়, তবুও সেখানকার আলোচকরা বইটি পড়ে তারপর হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে মুখ খোলার কথা ভাবেননি । আমার ডিটেকটিভ উপন্যাস ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ সম্পর্কে বহতা অংশুমালী লিখেছেন, “এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে। আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী। কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে। কিভাবে ক্যাপিটালিজমের, ব্যবসায়িক উদারনীতির, শিকার হয় অরণ্যের মানুষ। যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের “সমাজ” ব্যবস্থা , নীতিব্যবস্থা কে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না , যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই , তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন , কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টা কে পুলিশ অবলীলায় বলে ‘উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে ।’ এই ভারসাম্য ফেরত আসে , যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনিশ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই , কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে । সবুজ নষ্ট হয়ে যায় । মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয় ।” 

           এই উপন্যাসে আমার ভাষাশরীরে অশ্লীলতা নিয়েও এরকম মন্তব্য করেছেন বহতা অংশুমালী, “মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ অশ্লীল ছিলেন। যখন ‘লেডি চ্যাটার্লিস লাভার্স’ এ কনির মনে হয় নারীকে তার নারীত্ব থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আজকের পুরুষ আর সমাজ, বহু বায়বীয় কথার মধ্যে দিয়ে তার শরীরী রহস্য আর দেহোত্তীর্ণতা দুটোকেই নষ্ট করছে, তখন কংকাল প্রেমিক পরম যত্নে ধুইয়ে দেন প্রেমিকার অঙ্গ প্রেমিকার অনুজ্ঞায়, ঋতুস্রাবের পর। এই স্পর্শ আমাদের পরিচিত যৌনতার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এখানে ভালোবাসা যে কোনো ‘ইজম’ কে অতিক্রম করেছে। লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করেছেন কৃষ্ণ এখানে, শুধু রাধা বা গোপিনীর দল নয়। এই ভালোবাসায় নিরঞ্জন নিষিক্ত হতে থাকেন মায়ার সঙ্গে , সভ্যতা-ছেঁকে পাওয়া সভ্যতায় । মেয়েদের যৌনতাকে সমাজ সাধারণতঃ অশ্লীল মনে করে। এই উপন্যাসে লেখক সেই ঢেকে যাওয়া অর্ধেক আকাশকে টেনে নিয়ে এসেছেন অনেকখানি। নিরঞ্জনের কৈশোরে মিলি, তাদের খেলাধুলোয় কেবল কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা দেখায় না। সে আগে নিজে তৃপ্ত হয়ে নেয় নিরঞ্জনের মাধ্যমে। তারপর নিরঞ্জনকে নিয়ে যায় শিখরে। এই দেয়া নেয়ার সহজ হিসেবটুকু এই টেণ্ডারনেসের সঙ্গে আমি সচরাচর পাই নি কোন বাংলা উপন্যাসে। এই প্রসঙ্গের অবতারণা যখনই হয়েছে, কিছু বিকৃতির সঙ্গে করা হয়েছে। আবার লরেন্সের থেকে ভাবটি উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে— স্পর্শ ছাড়া কিই বা টিকে থাকে, শেষ পর্যন্ত দেহে মনে অস্তিত্বের শিকড়ে ? যদি স্পর্শ তেমন স্পর্শ হয় ।”

         মলয় ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে বিভিন্ন গল্পের প্রবেশ ঘটিয়েছেন এবং সেই গল্পগুলোর গদ্যবিন্যাস মূল ন্যারেটিভ থেকে ভিন্ন, চটকলের মজুর খুন করায় পুলিশের অত্যাচারের শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন, ডায়েরির ও নোটসের টুকরো রেখেছেন যাদের গদ্যবিন্যাস ভিন্ন । ‘আরেকবার ক্ষুধিত পাযাণ’ বড়ো গল্পে প্রয়োগ করেছেন সাধুবাংলা, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের প্যাশটিশ । জীবনানন্দের ‘আটবছর আগের একদিন’ কবিতাটিরও প্যাশটিশ লিখেছেন । প্যাশটিশ হলো একটি পোস্টমডার্ন টেকনিক । ‘হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা’ উপন্যাসে প্রয়োগ করেছি ভাষার লেভেল জামপিং, ইনটারলকিং এবং রাইজোম্যাটিক প্রক্রিয়া । একটা ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’, এতে কোনো অশ্লীল বা যৌন শব্দাবলী নেই ; তিনটি বিভিন্ন গদ্যবিন্যাস প্রয়োগ করেছেন, একটি একজন অধ্যাপকের ডায়েরিতে বিদ্যায়তনিক গদ্যে লেখা তাঁর দার্শনিক মতামতের ফাঁকে-ফাঁকে আরও দুজনের ডায়েরি, একজন যুবকের হিপিনি ও বাঙালি বধুসঙ্গের যৌন বিবরণ, সাধুভাষায় লেখা, এবং বাঙালি বধুটির যৌনকর্মের বিবরণ, আটপৌরে ভাষায় লেখা । বস্তুত মলয়ের, সুভাষ ঘোষের, সুবিমল বসাকের, অবনী ধরের, বাসুদেব দাশগুপ্তের উপন্যাসগুলো সবসুদ্ধ শতাধিক হবে, কজনই বা পড়েছেন সন্দেহ, অথচ না পড়েই অনেকে অনেকরকম মন্তব্য করতে থাকেন । সুতরাঙ হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা বলতে কোনো নির্দিষ্ট একটা কমপারর্টমেণ্টে তাকে আটক রাখা ভুল হবে ।

          হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে । অতএব যে কয়েকটি ক্ষেত্রে গবেষকরা একমত সেগুলি এখানে তুলে ধরা  যেতে পারে : (১). পত্রিকার নামকরণ : হাংরি আন্দোলনের পূর্বে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, পূর্বাশা, অরণি কৃত্তিবাস, অগ্রণি, শতভিষা,উত্তরসূরী, ধ্রুপদী, সংবেদ, ক্রান্তি, চতুরঙ্গ ইত্যাদি । হাংরি আন্দোলনকারীরা যে-ধরণের নাম রাখার চল করলেন তা বৈপ্লবিক । ফলে তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপুল পরিবর্তন ঘটল । যেমন, কৌরব, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, ঢ়পের কাগজ, আমি আর লীনা হঁটে চলেছি, ক্ষেপচুরিয়াস, দিল্লী হাটার্স ইত্যাদি । (২) সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গ থেকে সাহিত্যক্ষেত্রে আগমন, যা কবিতা, কৃত্তিবাস, শতভিষা, ধ্রুপদী ইত্যাদি পত্রিকায় দৃষ্টিকটুভাবে অনুপস্হিত থাকতো । হাংরি আন্দোলন প্রথম যৌথভাবে প্রন্তিকের ডিসকোর্সকে স্হান করে দিল । (৩). পাঠবস্তুতে মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির প্রচলন ,বিশেষ করে প্রদীপ চৌধুরী, ফালগুনী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা-বিশেষ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায়, স্তবক ও পংক্তি উপর-নিচ রদবদল করে পড়া যায় । একই প্রক্রিয়া গদ্যে এনেছেন সুভাষ ঘোষ, সমীর রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায় ও সুবিমল বসাক । (৪). মনস্হিতি প্রকাশকালীন অব্যয় শব্দ কবিতায় প্রয়োগ; যেমন ওঃ, আঃ, আহ, আআআআআআআহ‌,, উঃ, শ্যাঃ, ফুঃ, হাহ ইত্যাদি, বিশেষ করে মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী ও ফালগুনী রায়- এর কবিতায় । (৫). পাঠবস্তুতে অনুক্রমহীনতা প্রয়োগ : বাক্যবুননে লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তিফাটল প্রয়োগ যা দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখের কবিতার বৈশিষ্ট্য । সত্তর দশকের পর পশ্চিম বাংলায় এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে । (৬). গুরুচণ্ডালী শব্দগঠন ও বাক্য প্রয়োগ যা হাংরি আন্দোলনকারীদের পূর্বে নিষিদ্ধ ছিল বর্তমানে আকছার হয়ে গেছে । (৭). ভঙ্গুর বাকপ্রতিমা প্রয়োগ । হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতায় একটি ছবি সম্পূর্ণ গড়ে ওঠার আগেই তা মিলিয়ে গিয়ে আরেকটি ছবি ভেসে ওঠে । বাংলা কবিতায় এটি এখন প্রতিষ্ঠিত শৈলী । (৮). যৌন চিত্রকল্প, অশ্লীল শব্দ, গালমন্দ, নিচুতলার অভিব্যক্তি যা পাঁচের দশক পর্যন্ত পাঠবস্তুতে নিষিদ্ধ ছিল তার যথেচ্ছ প্রয়োগের সূত্রপাত করে গেছেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । (৯). তাঁদের পাঠবস্তুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিস্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন যে সেগুলো "সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক" । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর" করেছেন তাঁরা, এবং "যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তাঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যান" ।

বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব : অভিজিৎ পাল

বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব
অভিজিৎ পাল
বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । 

১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট ।

৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট ।

৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে ।

৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক, গয়লা পরিবারের সুভাষ ঘোষ, জাহাজের খালাসি অবনী ধর ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর নিম্নবর্গের কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। 

৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । 

৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । 

৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে ।

৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন ।

১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।